Bangla poem

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
---শেষের কবিতা উপন্যাস থেকে


পথ বেঁধে দিল বন্ধনহীন গ্রন্থি,
আমরা দুজন চলতি হাওয়ার পন্থী।
রঙিন নিমেষ ধুলার দুলাল
পরানে ছড়ায় আবীর গুলাল,
ওড়না ওড়ায় বর্ষার মেঘে
দিগঙ্গনার নৃত্য;
হঠাৎ-আলোর ঝলকানি লেগে
ঝলমল করে চিত্ত।

নাই আমাদের কনক-চাঁপার কুঞ্জ,
বনবীথিকায় কীর্ণ বকুলপুঞ্জ।
হঠাৎ কখন সন্ধেবেলায়
নামহারা ফুল গন্ধ এলায়,
প্রভাতবেলায় হেলাভরে করে
অরুণ মেঘেরে তুচ্ছ
উদ্ধত যত শাখার শিখরে
রডোডেনড্রনগুচ্ছ।


 প্রতিদান----
--- জসীম উদ্দিন

আমার এ ঘর
ভাঙিয়াছে যেবা আমি বাঁধি তার
ঘর,
আপন করিতে কাঁদিয়া বেড়াই
যে মোরে করেছে পর।

যে মোরে করিল পথের বিবাগী-
পথে পথে আমি ফিরি তার
লাগি,
দিঘল রজনী তার তরে জাগি ঘুম
যে হরেছে মোর;
আমার এ ঘর
ভাঙিয়াছে যেবা আমি বাঁধি তার
ঘর।

আমার এ কূল
ভাঙিয়াছে যেবা আমি তার কূল
বাঁধি,
যে গেছে বুকে আঘাত
করিয়া তার লাগি আমি কাঁদি।

যে মোরে দিয়েছে বিষে-
ভরা বাণ,
আমি দেই তারে বুকভরা গান,
কাঁটা পেয়ে তারে ফুল করি দান
সারাটি জনম-ভর,-
আপন করিতে কাঁদিয়া বেড়াই
যে মোরে করেছে পর।

মোর বুকে যেবা কবর
বেঁধেছে আমি তার বুক ভরি
রঙিন ফুলের সোহাগ-জড়ানো ফুল
মালঞ্চ ধরি।

যে মুখে কহে সে নিঠুরিয়া বাণী,
আমি লয়ে করে তারি মুখখানি,
কত ঠাঁই হতে কত
কীযে আনি সাজাই নিরন্তর-
আপন করিতে কাঁদিয়া ....।


___সুকুমার রায়

ভয় পেয়ো না, ভয় পেয়ো না, তোমায় আমি মারব না
সত্যি বলছি কুস্তি ক'রে তোমার সঙ্গে পারব না।

মনটা আমার বড্ড নরম, হাড়ে আমার রাগটি নেই,
তোমায় আমি চিবিয়ে খাব এমন আমার সাধ্যি নেই!

মাথায় আমার শিং দেখে ভাই ভয় পেয়েছ কতই না---
জানো না মোর মাথার ব্যারাম, কাউকে আমি গুঁতোই না?

এস এস গর্তে এস, বাস ক'রে যাও চারটি দিন,
আদর ক'রে শিকেয় তুলে রাখব তোমায় রাত্রিদিন।

হাতে আমার মুগুর আছে তাই কি হেথায় থাকবে না?
মুগুর আমার হাল্কা এমন মারলে তোমার লাগবে না।

অভয় দিচ্ছি শুনছ না যে? ধরব নাকি ঠ্যাং দুটা?
বসলে তোমার মুণ্ডু চেপে বুঝবে তখন কাণ্ডটা!

আমি আছি, গিন্নী আছেন, আছেন আমার নয় ছেলে
সবাই মিলে কামড়ে দেব মিথ্যে অমন ভয় পেলে।
 

মন ভালো নেই
------------- মহাদেব সাহা

বিষাদ ছুঁয়েছে আজ, মন ভালো নেই,
মন ভালো নেই;
ফাঁকা রাস্তা, শূন্য বারান্দা
সারাদিন ডাকি সাড়া নেই,
একবার ফিরেও চায় না কেউ
পথ ভুলকরে চলে যায়, এদিকে আসে না
আমি কি সহস্র সহস্র বর্ষ এভাবে
তাকিয়ে থাকবো শূন্যতার দিকে?
এই শূন্য ঘরে, এই নির্বসনে
কতোকাল, আর কতোকাল!
আজ দুঃখ ছুঁয়েছে ঘরবাড়ি,
উদ্যানে উঠেছে ক্যাকটাস্
কেউ নেই, কড়া নাড়ার মতো কেউ নেই,
শুধু শূন্যতার এই দীর্ঘশ্বাস, এই দীর্ঘ পদধ্বনি।
টেলিফোন ঘোরাতে ঘোরাতে আমি ক্লান্ত
ডাকতে ডাকতে একশেষ;
কেউ ডাক শোনে না, কেউ ফিরে তাকায় না
এই হিমঘরে ভাঙা চেয়ারে একা বসে আছি।
এ কী শাস্তি তুমি আমাকে দিচ্ছো ঈশ্বর,
এভাবে দগ্ধ হওয়ার নাম কি বেঁচে থাকা!
তবু মানুষ বেঁচে থাকতে চায়, আমি বেঁচে থাকতে চাই
আমি ভালোবাসতে চাই, পাগলের মতো
ভালোবাসতে চাই-
এই কি আমার অপরাধ!
আজ বিষাদ ছুঁয়েছে বুক, বিষাদ ছুঁয়েছে বুক
মন ভালো নেই, মন ভালো নেই;
তোমার আসার কথা ছিলো, তোমার যাওয়ার
কথা ছিল-
আসা-যাওয়ার পথের ধারে
ফুল ফোটানো কথা ছিলো
সেসব কিছুই হলো না, কিছুই হলো না;
আমার ভেতরে শুধু এক কোটি বছর ধরে অশ্রুপাত
শুধু হাহাকার
শুধু শূন্যতা, শূন্যতা।
তোমার শূন্য পথের দিকে তাকাতে তাকাতে
দুই চোখ অন্ধ হয়ে গেলো,
সব নদীপথ বন্ধ হলো, তোমার সময় হলো না-
আজ সারাদিন বিষাদপর্ব, সারাদিন তুষারপাত-
মন ভালো নেই, মন ভালো নেই


"পাগলী, তোমার সঙ্গে"
— জয় গোস্বামী

পাগলী, তোমার সঙ্গে ভয়াবহ জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে ধুলোবালি কাটাব জীবন
এর চোখে ধাঁধা করব, ওর জল করে দেব কাদা
পাগলী, তোমার সঙ্গে ঢেউ খেলতে যাব দু'কদম।
অশান্তি চরমে তুলব, কাকচিল
বসবে না বাড়িতে
তুমি ছুঁড়বে থালা বাটি, আমি ভাঙব কাঁচের বাসন
পাগলী, তোমার সঙ্গে বঙ্গভঙ্গ জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে ৪২ কাটাব জীবন।

মেঘে মেঘে বেলা বাড়বে,
ধনে পুত্রে লক্ষ্মী লোকসান লোকাসান
পুষিয়ে তুমি রাঁধবে মায়া প্রপন্ঞ্চ
ব্যন্জ্ঞন
পাগলী, তোমার সঙ্গে দশকর্ম জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার
সঙ্গে দিবানিদ্রা কাটাব জীবন।

পাগলী, তোমার সঙ্গে ঝোলভাত জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে মাংসরুটি কাটাব জীবন
পাগলী, তোমার সঙ্গে নিরক্ষর জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে চার অক্ষর কাটাব জীবন।

পাগলী, তোমার সঙ্গে বই দেখব
প্যারামাউন্ট হলে
মাঝে মাঝে মুখ
বদলে একাডেমি রবীন্দ্রসদন
পাগলী, তোমার সঙ্গে নাইট্যশালা জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে কলাকেন্দ্র
কাটাব জীবন।

পাগলী, তোমার সঙ্গে বাবুঘাট জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে দেশপ্রিয় কাটাব জীবন
পাগলী, তোমার সঙ্গে সদা সত্য জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে'কী মিথ্যুক'
কাটাব জীবন।

এক হাতে উপায় করব,
দুহাতে উড়িয়ে দেবে তুমি
রেস খেলব জুয়া ধরব ধারে কাটাব সহস্র রকম
লটারি,
তোমার সঙ্গে ধনলক্ষ্মী জীবন
কাটাব
লটারি, তোমার সঙ্গে মেঘধন কাটাব জীবন।

দেখতে দেখতে পূজা আসবে,
দুনিয়া চিত্কার করবে সেল
দোকানে দোকানে খুঁজব
রূপসাগরে অরূপরতন
পাগলী, তোমার সঙ্গে পূজাসংখ্যা জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে রিডাকশনে কাটাব জীবন।

পাগলী, তোমার সঙ্গে কাঁচা প্রুফ জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে ফুলপেজ কাটাব জীবন
পাগলী, তোমার সঙ্গে লে আউট জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে লে হালুয়া কাটাব জীবন।

কবিত্ব ফুড়ুত্ করবে, পিছু পিছু ছুটব না হা করে
বাড়ি ফিরে লিখে ফেলব বড়ো গল্প
উপন্যাসোপম
পাগলী, তোমার সঙ্গে কথাশিল্প জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে বকবকম কাটাব জীবন।

নতুন মেয়ের সঙ্গে দেখা করব
লুকিয়ে চুরিয়ে
ধরা পড়ব তোমার হাতে,
বাড়ি ফিরে হেনস্তা চরম
পাগলী, তোমার
সঙ্গে ভ্যাবাচ্যাকা জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে হেস্তনেস্ত
কাটাব জীবন।

পাগলী, তোমার সঙ্গে পাপবিদ্ধ জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে ধর্মমতে কাটাব জীবন
পাগলী, তোমার সঙ্গে পূজা বেদি জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে মধুমালা কাটাব জীবন।

দোঁহে মিলে টিভি দেখব, হাত
দেখাতে যাব জ্যোতিষীকে
একুশটা উপোস থাকবে, ছাব্বিশটা ব্রত উদযাপন
পাগলী, তোমার সঙ্গে ভাড়া বাড়ি জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে নিজ ফ্ল্যাট
কাটাব জীবন।

পাগলী, তোমার
সঙ্গে শ্যাওড়াফুলি জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে শ্যামনগর কাটাব জীবন
পাগলী, তোমার সঙ্গে রেল রোকো জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে লেট স্লিপ কাটাব জীবন।

পাগলী, তোমার সঙ্গে আশাপূর্ণা জীবন কাটাব
আমি কিনব ফুল, তুমি ঘর
সাজাবে যাবজ্জীবন
পাগলী, তোমার সঙ্গে জয় জওয়ান জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে জয় কিষান কাটাব জীবন।

সন্ধ্যেবেলা ঝগড়া হবে, হবে দুই
বিছানা আলাদা
হপ্তা হপ্তা কথা বন্ধ
মধ্যরাতে আচমকা মিলন
পাগলী, তোমার
সঙ্গে ব্রক্ষ্মচারী জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে আদম ইভ কাটাব জীবন।

পাগলী, তোমার সঙ্গে রামরাজ্য জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার
সঙ্গে প্রজাতন্ত্রী কাটাব জীবন
পাগলী, তোমার সঙ্গে ছাল চামড়া জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে দাঁতে দাঁত কাটাব জীবন।

এর গায়ে কনুই মারব রাস্তা করব
ওকে ধাক্কা দিয়ে
এটা ভাঙলে ওটা গড়ব, ঢেউ খেলব দু দশ কদম
পাগলী, তোমার সঙ্গে ধুলোঝড় জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে'ভোর ভয়োঁ'কাটাব জীবন।



ওই তো বেজেছ তব প্রভাতের বাঁশি
– চিত্তরঞ্জন দাশ

ওই তো বেজেছ তব প্রভাতের বাঁশী –
আনন্দ উৎসবে ভরা!
সূর্যকর রাশি
তোমার সর্বাঙ্গে আজ আনন্দে লুটায়,
উজল উছল জলে কুসুম ফুটায়!

গীতভরা স্বর্ণালোকে ফুটে পুষ্পদল,
তোমার চরণ বেড়ি করে টলমল!

তোমার সঙ্গীত আজি বিহঙ্গের প্রায়,
মাখি সে সোনার স্বপ্ন তার সর্ব গায়,

উড়িয়া বেড়ায় মোর হৃদয় আকাশে,
প্রেমের তরঙ্গে আর বসন্ত বাতাসে!


ভয় পেয়ো না
___সুকুমার রায়

ভয় পেয়ো না, ভয় পেয়ো না, তোমায় আমি মারব না
সত্যি বলছি কুস্তি ক'রে তোমার সঙ্গে পারব না।

মনটা আমার বড্ড নরম, হাড়ে আমার রাগটি নেই,
তোমায় আমি চিবিয়ে খাব এমন আমার সাধ্যি নেই!

মাথায় আমার শিং দেখে ভাই ভয় পেয়েছ কতই না---
জানো না মোর মাথার ব্যারাম, কাউকে আমি গুঁতোই না?

এস এস গর্তে এস, বাস ক'রে যাও চারটি দিন,
আদর ক'রে শিকেয় তুলে রাখব তোমায় রাত্রিদিন।

হাতে আমার মুগুর আছে তাই কি হেথায় থাকবে না?
মুগুর আমার হাল্কা এমন মারলে তোমার লাগবে না।

অভয় দিচ্ছি শুনছ না যে? ধরব নাকি ঠ্যাং দুটা?
বসলে তোমার মুণ্ডু চেপে বুঝবে তখন কাণ্ডটা!

আমি আছি, গিন্নী আছেন, আছেন আমার নয় ছেলে
সবাই মিলে কামড়ে দেব মিথ্যে অমন ভয় পেলে।


একটি মেয়ের জন্য
--- রুদ্র গোস্বামী

একা ফুটপাথ
আলো ককটেল
ভিজে নাগরিক রাত পদ্য।

তুই হেঁটে যাস
কাঁচ কুয়াশায়
জল ভ্রূণ ভাঙা চাঁদ সদ্য।

আমি প্রশ্ন
তুই বিস্ময়
চোখ চশমার নীচে বন্ধ।

ঠোঁট নির্বাক
চাওয়া বন্য
আমি ভুলে যাই দ্বিধা দ্বন্দ্ব।

জাগা রাত্রি
ঘুম পস্তায়
মোড়া রূপকথা পিচ রাস্তা

পোষা স্বপ্ন
ছিঁড়ে ছারখার
প্রিয় রিংটোন লাগে সস্তা।

তুই সত্যি
আরও সত্যি
তুই শিশিরের কুঁড়ি পদ্ম।

বাকি মিথ্যে
সব মিথ্যে
চেনা চার দেয়ালের গদ্য।

__রুদ্র মুহন্মদ শহিদুল্লাহ

ব্যথা দাও,বুকে রাখবো
ব্যথার জন্যই তো হৃদয়
আঘাতে বুক ভাঙবে না
বুকে ব্যথা আছে।

গলিত লাভাগুলো বেদনার
যেন ঘনীভূত পাথরের দেহ
আঘাতে পাথর কখনো গলে না
গলে না হৃদয়।

পাহাড়ে ধস নামলে কখনো
মাটি অনায়াসে পেতে দেয় বুক।
তুমি যাবতীয় দুঃখকে ছুঁড়ে দাও
আমি বুক পেতে নেবো
বুক ভাঙবে না।

দুয়ার বন্ধ করলেই
আমি ফিরে যাবো নির্বিকার,
অস্বীকার করো মেনে নেবো।

এলবামে স্মৃতি নেই বলে
আদৌ দুঃখ করি না,
সোনালি নিসঙ্গতায় আমার
বিচিত্র দুঃখের সমাবেশ সঞ্চয় – ।

ব্যথা দাও,বুকে রাখবো
ব্যথায় ভাঙবে না বুক
বুকে ব্যথা আছে |


"----প্রেম"
-মিমোসা নূপুর

তুমি এমনই এক নীরব,স্তব্ধ প্রেম
আমায় উপহার দিলে..
যে মাঝেমাঝে খুব নিরবতা
ভাঙার লোভ হয়!

মনে হয় তোমাকে বলি-
এভাবে এত নিশ্চুপ,নিস্তব্ধতায়
আমাকে আর রেখো না..

পরে আবার নিজেকেই স্বান্তনা দিই-
মনে মনে ভাবি-আমার 'প্রেম' সেই অন্যরকম এক ভালবাসার কংক্রিটের
সাথে...
যে মৌনতা খুব ভালবাসে..!!



পথহারা
– কাজী নজরুল ইসলাম

বেলা শেষে উদাস পথিক ভাবে,
সে যেন কোন অনেক দূরে যাবে -
উদাস পথিক ভাবে।

‘ঘরে এস’ সন্ধ্যা সবায় ডাকে,
‘নয় তোরে নয়’ বলে একা তাকে;
পথের পথিক পথেই বসে থাকে,
জানে না সে কে তাহারে চাবে।
উদাস পথিক ভাবে।

বনের ছায়া গভীর ভালোবেসে
আঁধার মাথায় দিগবধূদের কেশে,
ডাকতে বুঝি শ্যামল মেঘের দেশে
শৈলমূলে শৈলবালা নাবে -
উদাস পথিক ভাবে।

বাতি আনি রাতি আনার প্রীতি,
বধূর বুকে গোপন সুখের ভীতি,
বিজন ঘরে এখন সে গায় গীতি,
একলা থাকার গানখানি সে গাবে -
উদাস পথিক ভাবে।

হঠাৎ তাহার পথের রেখা হারায়
গহন বাঁধায় আঁধার-বাঁধা কারায়,
পথ-চাওয়া তার কাঁদে তারায় তারায়
আর কি পূবের পথের দেখা পাবে
উদাস পথিক ভাবে।
 

বরষার প্রথম দিনে
___ হুমায়ূন আহমেদ

বরষার প্রথম দিনে
ঘন কালো মেঘ দেখে,
আনন্দে যদি কাঁপে তোমার হৃদয়,
সেদিন তাহার সাথে কর পরিচয়,
কাছে কাছে থেকেও যে কভু কাছে নয়।।

জীবনের সব ভুল,
যদি ফুল হয়ে যায়।।

যদি কোন দিন আসে জোছনার আঁচলে ঢাকা,
মধুর সময়।

তখন কাছে এসো,
তাহাকে ভালোবেসো,
সেদিন তাহার সাথে কর পরিচয়,
কাছে কাছে থেকেও যে কভু কাছে নয়।

জীবনের সব কালো,
যদি আলো হয়ে যায়।

দূর হয়ে যায় যদি ছায়াদের আঁধার সময়।

তখন কাছে এসো,
তাহাকে ভালোবেসো,
ছায়াময়ী কারো সাথে করো পরিচয়।

কাছে কাছে থেকেও যে কভু কাছে নয়।


ভালবাসার সময় তো নেই
– রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ

ভালবাসার সময় তো নেই
ব্যস্ত ভীষন কাজে,
হাত রেখো না বুকের গাড় ভাজে।

ঘামের জলে ভিজে সাবাড়
করাল রৌদ্দুরে,
কাছএ পাই না, হৃদয়- রোদ দূরে।

কাজের মাঝে দিন কেটে যায়
কাজের কোলাহল
তৃষ্নাকে ছোয় ঘড়ায় তোলা জল।

নদী আমার বয় না পাশে
স্রোতের দেখা নেই,
আটকে রাখে গেরস্থালির লেই।

তোমার দিকে ফিরবো কখন
বন্দী আমার চোখ
পাহারা দেয় খল সামাজিক নখ।


জীবনের হিসাব''
....সুকুমার রায়

বিদ্যেবোঝাই বাবুমশাই চড়ি সখের বোটে
মাঝিরে কন, "বলতে পারিস সূর্যি কেন ওঠে ?
চাঁদটা কেন বাড়ে কমে ? জোয়ার কেন আসে ?"
বৃদ্ধ মাঝি অবাক হয়ে ফ্যালফেলিয়ে হাসে।

বাবু বলেন, "সারা জনম মরলিরে তুই খাটি,
জ্ঞান বিনা তোর জীবনটা যে চারি আনাই মাটি।"

খানিক বাদে কহেন বাবু "বলত দেখি ভেবে
নদীর ধারা কেমনে আসে পাহাড় হতে নেবে ?
বলত কেন লবণপোরা সাগর ভরা পানি ?"

মাঝি সে কয়, "আরে মশাই অত কি আর জানি ?"
বাবু বলেন, "এই বয়সে জানিসনেও তা কি
জীবনটা তোর নেহাৎ খেলো, অষ্ট আনাই ফাঁকি ?"

আবার ভেবে কহেন বাবু "বলতো ওরে বুড়ো,
কেন এমন নীল দেখা যায় আকাশের ঐ চূড়ো ?

বলত দেখি সূর্য চাঁদে গ্রহণ লাগে কেন ?"
বৃদ্ধ বলে, "আমায় কেন লজ্জা দেছেন হেন ?"
বাবু বলেন, "বলব কি আর, বলব তোরে কি তা,--
দেখছি এখন জীবনটা তোর বারো আনাই বৃথা।"

খানিক বাদে ঝড় উঠেছে, ঢেউ উঠেছে ফুলে,
বাবু দেখেন, নৌকোখানি ডুবল বুঝি দুলে !

মাঝিরে কন, "একি আপদ ! ওরে ও ভাই মাঝি,
ডুবল নাকি নৌকো এবার ? মরব নাকি আজি ?"
মাঝি শুধায়, "সাঁতার জানো ?" --মাথা নাড়েন বাবু,
মূর্খ মাঝি বলে, "মশাই, এখন কেন কাবু ?

বাঁচলে শেষে আমার কথা হিসেব করো পিছে,
তোমার দেখি জীবন খানা ষোল আনাই মিছে।"


"উল্টো ঘুড়ি"
__রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ

এতো সহজেই ভালোবেসে ফেলি কেন!
বুঝিনা আমার রক্তে কি আছে নেশা-
দেবদারু-চুলে উদাসী বাতাস মেখে
স্বপ্নের চোখে অনিদ্রা লিখি আমি,
কোন বেদনার বেনোজলে ভাসি সারাটি স্নিগ্ধ রাত?

সহজেই আমি ভালোবেসে ফেলি, সহজে ভুলিনা কিছু-
না-বলা কথায় তন্ত্রে তনুতে পুড়ি,
যেন লাল ঘুড়ি একটু বাতাস পেয়ে
উড়াই নিজেকে আকাশের পাশাপাশি।

সহজে যদিও ভালোবেসে ফেলি
সহজে থাকিনা কাছে,
পাছে বাঁধা পড়ে যাই।

বিস্মিত তুমি যতোবার টানো বন্ধন-সুতো ধ’রে,
আমি শুধু যাই দূরে।

আমি দূরে যাই-
স্বপ্নের চোখে তুমি মেখে নাও ব্যথা-চন্দন চুয়া,
সারাটি রাত্রি ভাসো উদাসীন বেদনার বেনোজলে…
এতো সহজেই ভালোবেসে ফেলো কেন?


হিসেব
---- তসলিমা নাসরিন

কতটুকু ভালবাসা দিলে,
ক' তোড়া গোলাপ দিলে,
কতটুকু সময়,কতটা সমুদ্র দিলে,
কটি নির্ঘুম রাত দিলে,ক ফোঁটা জল দিলে চোখের—

সব যেদিন ভীষন আবেগে শোনাচ্ছিলে আমাকে,
বোঝাতে চাইছিলে আমাকে খুব ভালোবাসো!

আমি বুঝে নিলাম—
তুমি আমাকে এখন আর 'একটু ও ভালোবাসো না।

ভালোবাসা ফুরোলেই মানুষ হিসেব কষতে বসে,
তুমিও বসেছো।

ভালোবাসা ততদিনই ভালোবাসা
যতদিন এটি অন্ধ থাকে,বধির থাকে,
যতদিন এটি বেহিসেবি থাকে।


মুনাজাত
– কাজী নজরুল ইসলাম

আমারে সকল ক্ষুদ্রতা হতে
বাঁচাও প্রভু উদার।
হে প্রভু! শেখাও – নীচতার চেয়ে
নীচ পাপ নাহি আর।

যদি শতেক জন্ম পাপে হই পাপী,
যুগ-যুগান্ত নরকেও যাপি,
জানি জানি প্রভু, তারও আছে ক্ষমা-
ক্ষমা নাহি নীচতার।।

ক্ষুদ্র করো না হে প্রভু আমার
হৃদয়ের পরিসর,
যেন সম ঠাঁই পায়
শত্রু-মিত্র-পর।

নিন্দা না করি ঈর্ষায় কারো
অন্যের সুখে সুখ পাই আরো,
কাঁদি তারি তরে অশেষ দুঃখী
ক্ষুদ্র আত্মা তার।।

‘‘ব্যথা দাও,বুকে রাখবো’’
__রুদ্র মুহন্মদ শহিদুল্লাহ

ব্যথা দাও,বুকে রাখবো
ব্যথার জন্যই তো হৃদয়
আঘাতে বুক ভাঙবে না
বুকে ব্যথা আছে।

গলিত লাভাগুলো বেদনার
যেন ঘনীভূত পাথরের দেহ
আঘাতে পাথর কখনো গলে না
গলে না হৃদয়।

পাহাড়ে ধস নামলে কখনো
মাটি অনায়াসে পেতে দেয় বুক।
তুমি যাবতীয় দুঃখকে ছুঁড়ে দাও
আমি বুক পেতে নেবো
বুক ভাঙবে না।

দুয়ার বন্ধ করলেই
আমি ফিরে যাবো নির্বিকার,
অস্বীকার করো মেনে নেবো।

এলবামে স্মৃতি নেই বলে
আদৌ দুঃখ করি না,
সোনালি নিসঙ্গতায় আমার
বিচিত্র দুঃখের সমাবেশ সঞ্চয় – ।

ব্যথা দাও,বুকে রাখবো
ব্যথায় ভাঙবে না বুক
বুকে ব্যথা আছে |


অনির্ণীত নারী
— হেলাল হাফিজ

নারী কি নদীর মতো
নারী কি পুতুল,
নারী কি নীড়ের নাম
টবে ভুল ফুল।

নারী কি বৃক্ষ কোনো
না কোমল শিলা,
নারী কি চৈত্রের চিতা
নিমীলিত নীলা।


রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
------শেষের কবিতা উপন্যাস থেকে

পথ বেঁধে দিল বন্ধনহীন গ্রন্থি,
আমরা দুজন চলতি হাওয়ার পন্থী।
রঙিন নিমেষ ধুলার দুলাল
পরানে ছড়ায় আবীর গুলাল,

ওড়না ওড়ায় বর্ষার মেঘে
দিগঙ্গনার নৃত্য;
হঠাৎ-আলোর ঝলকানি লেগে
ঝলমল করে চিত্ত।

নাই আমাদের কনক-চাঁপার কুঞ্জ,
বনবীথিকায় কীর্ণ বকুলপুঞ্জ।

হঠাৎ কখন সন্ধেবেলায়
নামহারা ফুল গন্ধ এলায়,
প্রভাতবেলায় হেলাভরে করে
অরুণ মেঘেরে তুচ্ছ
উদ্ধত যত শাখার শিখরে
রডোডেনড্রনগুচ্ছ।

নাই আমাদের সঞ্চিত ধনরত্ন,
নাই রে ঘরের লালন ললিত যত্ন।
পথপাশে পাখি পুচ্ছ নাচায়,
বন্ধন তারে করি না খাঁচায়,
ডানা-মেলে-দেওয়ামুক্তিপ্রিয়ের
কূজনে দুজনে তৃপ্ত।
আমরা চকিত অভাবনীয়ের
ক্কচিৎ-কিরণে দীপ্ত।


মানসী
--- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

শুধু বিধাতার সৃষ্টি নহ তুমি নারী!
পুরুষ গড়েছে তোরে সৌন্দর্য সঞ্চারি
আপন অন্তর হতে। বসি কবিগণ
সোনার উপমাসূত্রে বুনিছে বসন।

সঁপিয়া তোমার ‘পরে নূতন মহিমা
অমর করেছে শিল্পী তোমার প্রতিমা।

কত বর্ণ, কত গন্ধ, ভূষণ কত-না -
সিন্ধু হতে মুক্তা আসে, খনি হতে সোনা,
বসন্তের বন হতে আসে পুষ্পভার,
চরণ রাঙাতে কীট দেয় প্রাণ তার।

লজ্জা দিয়ে, সজ্জা দিয়ে, দিয়ে আবরণ,
তোমারে দুর্লভ করি করেছে গোপন।

পড়েছে তমার ‘পরে প্রদীপ্ত বাসনা -
অর্ধেক মানবী তুমি, অর্ধেক কল্পনা।


বিদায় বেলায়
– কাজী নজরুল ইসলাম

তুমি অমন ক’রে গো বারে বারে জল-ছল-ছল চোখে চেয়ো না,
জল-ছল-ছল চোখে চেয়ো না।
ঐ কাতর কন্ঠে থেকে থেকে শুধু বিদায়ের গান গেয়ো না,
শুধু বিদায়ের গান গেয়ো না।।

হাসি দিয়ে যদি লুকালে তোমার সারা জীবনের বেদনা,
আজো তবে শুধু হেসে যাও, আজ বিদায়ের দিনে কেঁদো না।

ঐ ব্যথাতুর আঁখি কাঁদো-কাঁদো মুখ
দেখি আর শুধু হেসে যাও,আজ বিদায়ের দিনে কেঁদো না।

চলার তোমার বাকী পথটুকু-
পথিক! ওগো সুদূর পথের পথিক-
হায়, অমন ক’রে ও অকর”ণ গীতে আঁখির সলিলে ছেয়ো না,
ওগো আঁখির সলিলে ছেয়ো না।।

দূরের পথিক! তুমি ভাব বুঝি
তব ব্যথা কেউ বোঝে না,
তোমার ব্যথার তুমিই দরদী একাকী,
পথে ফেরে যারা পথ-হারা,
কোন গৃহবাসী তারে খোঁজে না,
বুকে ক্ষত হ’য়ে জাগে আজো সেই ব্যথা-লেখা কি?

দূর বাউলের গানে ব্যথা হানে বুঝি শুধু ধূ-ধূ মাঠে পথিকে?
এ যে মিছে অভিমান পরবাসী! দেখে ঘর-বাসীদের ক্ষতিকে!

তবে জান কি তোমার বিদায়- কথায়
কত বুক-ভাঙা গোপন ব্যথায়
আজ কতগুলি প্রাণ কাঁদিছে কোথায়-
পথিক! ওগো অভিমানী দূর পথিক!

কেহ ভালোবাসিল না ভেবে যেন আজো
মিছে ব্যথা পেয়ে যেয়ো না,
ওগো যাবে যাও, তুমি বুকে ব্যথা নিয়ে যেয়ো না।।


‘‘আমি খুব অল্প কিছু চাই !’’
___হুমায়ূন আহমেদ

আমাকে ভালবাসতে হবে না,
ভালবাসি বলতে হবে না.
মাঝে মাঝে গভীর আবেগ
নিয়ে আমার ঠোঁট
দুটো ছুয়ে দিতে হবে না.
কিংবা আমার জন্য রাত
জাগা পাখিও
হতে হবে না.
অন্য সবার মত আমার
সাথে রুটিন মেনে দেখা
করতে হবে না. কিংবা বিকেল বেলায় ফুচকাও
খেতে হবে না. এত
অসীম সংখ্যক “না”এর ভিড়ে
শুধু মাত্র একটা কাজ
করতে হবে আমি যখন
প্রতিদিন এক বার “ভালবাসি” বলব
তুমি প্রতিবার
একটা দীর্ঘশ্বাস
ফেলে একটু
খানি আদর মাখা
গলায় বলবে “পাগলি”
বিশ্বাস কর!


ইচ্ছে
--- তাছলিমা হক

ইচেছরা সব এদিক ওদিক
করে ছুটাছুটি
মনের মাঝে বাস যে তাদের
সেথায় লুটোপুটি
ইচেছ গাছের দিনে দিনে গজায়
শাখা - প্রশাখা
ইচেছরা সব ডানা মেলে
মেলে রঙিন পাখা
ইচেছ করে গাছে গাছে আগের মতো চড়ি
ইচেছ করে নীল আকাশে উড়াই রঙিন ঘুড়ি
ইচেছ করে প্রখর রোদে আচছা মতো পুড়ি
ইচেছ করে শীলা বৃষিটতে কুড়াই শীল নুড়ি
ইচেছরা সব শান্ত মনকে করে যে অশান্ত
ইচেছ করে ছুটে যাই শুরু থেকে শেষ প্রান্ত
ইচেছ জাগে.ইচেছ ঘুমায় মনের মাঝেই বাস
ইচেছ বাঁচে.ইচেছ মরে সামান্যই তো আশ
ইচেছ শুধুই ছুটে চলা
মনের সকল কথা বলা
পায়ে পায়ে পথ চলা
ইচেছ তোমার হাতটি ধরে
খুঁজবো যে পথ পথ হারিয়ে।


‘‘শেষ হ’ল জীবনের সব লেনদেন’’
____জীবনানন্দ দাশ

শেষ হ’ল জীবনের সব লেনদেন,
বনলতা সেন।
কোথায় গিয়েছ তুমি আজ এই বেলা
মাছরাঙা ভোলেনি তো দুপুরের খেলা
শালিখ করে না তার নীড় অবহেলা
উচ্ছ্বাসে নদীর ঢেউ হয়েছে সফেন,
তুমি নাই বনলতা সেন।

তোমার মতন কেউ ছিল কি কোথাও?
কেন যে সবের আগে তুমি চলে যাও।

কেন যে সবের আগে তুমি
পৃথিবীকে করে গেলে শূন্য মরুভূমি
(কেন যে সবের আগে তুমি)
ছিঁড়ে গেলে কুহকের ঝিলমিল টানা ও পোড়েন,
কবেকার বনলতা সেন।

কত যে আসবে সন্ধ্যা প্রান্তরে আকাশে,
কত যে ঘুমিয়ে রবো বস্তির পাশে,
কত যে চমকে জেগে উঠব বাতাসে
হিজল জামের
বনে থেমেছে স্টেশনে বুঝি রাত্রির ট্রেন,
নিশুথির বনলতা সেন ।


সম্প্রদান
- হেলাল হাফিজ

ভাদ্রের বর্ধিত আষাঢ়ে সখ্য হয়েছিলো।
সে প্রথম, সে আমার শেষ।

পথে ও প্রান্তরে, ঘরে,
দিতে রাতে, মাসে ও বছরে
সমস্ত সাম্রাজ্য জুড়ে
সে আষাঢ় অতোটা ভেজাবে আমি ভাবিনি কসম।

আমার সকল শ্রমে, মেধা ও মননে
নিদারুণ নম্র খননে
কী নিপুণ ক্ষত দেখো বানিয়েছে চতুর আষাঢ়।

একদিন
সব কিছু
ছিলো তোর
ডাক নামে,
পোড়ামুখী
তবু তোর
ভরলো না মন,—
এই নে হারামজাদী একটা জীবন।

আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে
– কাজী নজরুল ইসলাম

আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে–
মোর মুখ হাসে মোর চোখ হাসে মোর টগবগিয়ে খুন হাসে
আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে।

আজকে আমার রুদ্ধ প্রাণের পল্বলে -
বান ডেকে ঐ জাগল জোয়ার দুয়ার – ভাঙা কল্লোলে।

আসল হাসি, আসল কাঁদন
মুক্তি এলো, আসল বাঁধন,
মুখ ফুটে আজ বুক ফাটে মোর তিক্ত দুখের সুখ আসে।
ঐ রিক্ত বুকের দুখ আসে -
আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে!

আসল উদাস, শ্বসল হুতাশ
সৃষ্টি-ছাড়া বুক-ফাটা শ্বাস,
ফুললো সাগর দুললো আকাশ ছুটলো বাতাস,
গগন ফেটে চক্র ছোটে, পিণাক-পাণির শূল আসে!

ঐ ধূমকেতু আর উল্কাতে
চায় সৃষ্টিটাকে উল্টাতে,
আজ তাই দেখি আর বক্ষে আমার লক্ষ বাগের ফুল হাসে
আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে!

আজ হাসল আগুন, শ্বসল ফাগুন,
মদন মারে খুন-মাখা তূণ
পলাশ অশোক শিমুল ঘায়েল
ফাগ লাগে ঐ দিক-বাসে
গো দিগ বালিকার পীতবাসে;
আজ রঙ্গন এলো রক্তপ্রাণের অঙ্গনে মোর চারপাশে
আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে!

আজ কপট কোপের তূণ ধরি,
ঐ আসল যত সুন্দরী,
কারুর পায়ে বুক ডলা খুন, কেউ বা আগুন,
কেউ মানিনী চোখের জলে বুক ভাসে!

তাদের প্রাণের ‘বুক-ফাটে-তাও-মুখ-ফোটে-না’ বাণীর বীণা মোর পাশে
ঐ তাদের কথা শোনাই তাদের
আমার চোখে জল আসে
আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে!

আজ আসল ঊষা, সন্ধ্যা, দুপুর,
আসল নিকট, আসল সুদূর
আসল বাধা-বন্ধ-হারা ছন্দ-মাতন
পাগলা-গাজন-উচ্ছ্বাসে!

ঐ আসল আশিন শিউলি শিথিল
হাসল শিশির দুবঘাসে
আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে!

আজ জাগল সাগর, হাসল মরু
কাঁপল ভূধর, কানন তরু
বিশ্ব-ডুবান আসল তুফান, উছলে উজান
ভৈরবীদের গান ভাসে,
মোর ডাইনে শিশু সদ্যোজাত জরায়-মরা বামপাশে।

মন ছুটছে গো আজ বল্গাহারা অশ্ব যেন পাগলা সে।
আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে!
আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে!!


"ভালোবাসা মোরে ভিখারি করেছে"
___কাজী নজরুল ইসলাম

ভালোবাসা মোরে ভিখারি করেছে
তোমারে করেছে রাণী ।
তোমারই দুয়ারে কুড়াতে এসেছি
ফেলে দেওয়া মালাখানি,

নয়নের জলে যে কথা জানাই
সে ব্যথা আমার কেহ বোঝে নাই
মেঘের মরমে যে মিনতি কাঁদে
চাঁদ বুঝিবে না জানি;

ভালোবাসা মোরে ভিখারি করেছে
তোমারে করেছে রাণী ।

মাধবীলতা গো আজ তুমি
আছ ফুলের স্বপন সুখে
একদিন যবে ফুল ঝরে যাবে
লুটাবে ধূলির বুকে ।

খেয়ালী প্রেমের খেলা বোঝা দায়,
কখনো হাসায় কখনো কাঁদায়
মুক হয়ে যায় কারও মুখরতা,
কারও মুখে জাগে বাণী

ভালোবাসা মোরে ভিখারি করেছে
তোমারে করেছে রাণী । 


 

 

 

 

  

 

     

 
 

     

No comments:

Post a Comment